সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস ( সংগঠনটি প্রথমে আইএসআইএল নামে আত্মপ্রকাশ করে) এর কারণে ‘ইয়াজিদি’ সম্প্রদায়টির নাম গণমাধ্যমে বারবার আসছে। সম্প্রতি উত্তর ইরাকের শিনজার পর্বতে প্রায় ৪০ হাজার ইয়াজিদিকে আটকে রাখে আইএস সদস্যরা। সেখান থেকে বের হলে আইএসের গুলিতে মৃত্যু আর আটকে থাকলে ক্ষুধা তৃষ্ণায় মৃত্যু এ রকম দ্বিমুখী চাপের মধ্যে ছিল সম্প্রদায়ের মানুষগুলো। এ রকম অবস্থায় সম্প্রদায়টির ৫০টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেেই উত্তর ইরাকে আইএসকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানো শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। আসলে কারা এই ইয়াজিদি, কী এদের পরিচয়? তাদের প্রতি কথিত সুন্নি বিদ্রোহীদের ক্ষোভের কারণটাই বা কী?
ইয়াজিদি নাম শুনলেই অনেকের মনে হতে পারে এরা ইসলামের পঞ্চম খলিফা মুয়াবিয়ার ছেলে ইয়াজিদের বংশধর (ইয়াজিদ নিজেও ষষ্ঠ খলিফা ছিলেন)। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইয়াজিদিদের সঙ্গে ইয়াজিদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরেও শুধু ইয়াজিদের নামের সঙ্গে মিল থাকার কারণেই সুন্নি ও শিয়া মুসলিমদের কাছে ঘৃণিত হয়ে আসছে এই সম্প্রদায়টি। কেননা উমাইয়া বংশের খলিফা ইয়াজিদের প্রতি সুন্নি ও শিয়া উভয় অংশের প্রচণ্ড ঘৃণা রয়েছে। কারণ তার ষড়যন্ত্রেই মহানবীর (সা.) দুই দৌহিত্র ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসেনকে (রা.) হত্যা করা হয়।
এদিকে ইয়াজিদি হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত এই সম্প্রদায়টি নিজেদের পরিচয় দেয় ‘দাসিন’ হিসেবে। ইয়াজিদি শব্দটি এসেছে ফার্সি ইজদ থেকে যার অর্থ দেবদূত। ইয়াজিদিদের প্রতি ঘৃণার অন্য একটি কারণ হলো তাদের রহস্যময় ধর্মীয় বিশ্বাস। গবেষকদের মতে সম্প্রদায়টির ধর্মীয় বিশ্বাস গড়ে উঠেছে খ্রিস্টান, ইসলাম, ইহুদি, জরথ্রুস্টবাদের মতো ধর্মগুলো থেকে। ইয়াজিদিদের বিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তা পুরো বিশ্বকে সৃষ্টি করার পর সাতটি পবিত্র আত্মার হাতে এর দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন। এদের মধ্যে প্রধান আত্মাটির নাম মালিক তাউস। ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্ম অনুসারে, মালিক তাউস আসলে শয়তানের অপর নাম। সে কারণে ইয়াজিদিদেরকে অনেক মুসলিম ও খ্রিস্টান শয়তানের উপাসক মনে করে। তবে কুর্দিশ ভাষাতাত্ত্বিক জামেল নেবেজের মতে, তাউস শব্দটি গ্রিক যার অর্থ সৃষ্টিকর্তা।
এদিকে বর্তমানে সুন্নি বিদ্রোহীদের কোপানলে পড়লেও সুন্নি শাসক সাদ্দামের সুদৃষ্টিতেই ছিল ইয়াজিদিরা। তার শাসনামলে এ সম্প্রদায়টিকে আরবদেরই একটি অংশ হিসেবে মনে করা হতো। এসময় তাদেরকে কুর্দিদের বিপক্ষে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়। তবে কুর্দিস্তান আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হয়ে যাওয়ার পর থেকেই উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ কুর্দি সশস্ত্র সংগঠন পেসমার্গার হয়ে সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। ২০০৩ সালের পর থেকেই কুর্দিরা ইয়াজিদিদের কুর্দিদের একটি অংশ হিসেবে মেনে নিলেও সব সময় বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করেনি।
জাতিগত দিক থেকে উত্তর ইরাকের এই সম্প্রদায়টি কুর্দিদের একটি অংশ। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টের জন্মের দু’হাজার বছর আগে থেকে এই সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে সারা বিশ্বে এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে পুরো বিশ্বে সম্প্রদায়টির এক লাখের বেশি অনুসারী রয়েছে। তবে সম্প্রদায়টির নিজেদের ওয়েবসাইটে দাবি করা হয় তাদের সংখ্যা আট লাখের মতো। ওয়েবসাইটটির দাবি অনুযায়ী কেবল জার্মানিতেই সম্প্রদায়টির ৩০ হাজার শরণার্থী রয়েছে।
সম্প্রদায়টির মধ্যে নারীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী প্রচলিত রয়েছে। পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে নারী হত্যা ও সম্প্রদায়ের বাইরে নারীদের বিয়ের ব্যাপারে বেশ কড়াকড়ি রয়েছে। কিছু দিন আগে সুন্নি একটি ছেলেকে বিয়ে করার কারণে সম্প্রদায়টির এক নারীকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়। গণমাধ্যমে ঘটনাটি ফাঁস হওয়ার পর সম্প্রদায়টিতে নারীদের অপমানজনক অবস্থানের কথা ফাঁস হয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment